
আমি মাছ খাই না"
মুহাম্মদ ফায়জুর রহমান
এই লেখাটি একটি অপ্রত্যাশিত লেখা বলেই আমি মনে করি। কিছু জিনিষ লিখনীর পূর্বে অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক থাকে অথবা বলা যায় যে প্ল্যান করেই লেখা। ঠিক যেমন আমি কারো থেকে দুয়া চাওয়ার জন্য প্ল্যান করেই স্ট্যাটাস লিখে জানিয়ে দেই; যাতে করে আমি দুয়া কামনা করতে পারি অন্যদের থেকে। কিন্তু আজের বেলায় ব্যাপারটি ভিন্ন। আমি এই লেখাটির জন্য কোনো পূর্বপরিকল্পনা করিনি। তবে আমি মাছ খাওয়ায় পূর্বপরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু মাছ খাওয়ায় পরিকল্পনায় অপ্রত্যাশিত এই লিখনীর আবিষ্কার করবো কল্পনাই করিনি।
শুরু থেকে বললে, ভ্রমণের এক মৃদু অন্ধকার অবসরে ফেসবুকের একটি ভিডিওতে মাঝ সমুদ্রে একটি মাঝারি সু-বিশাল শিপে ভিনদেশী ৩ জন ফিশারম্যানকে স্যালমন মাছ ধরতে দেখেছিলাম। সমুদ্রের গাঢ় নীল আবছা রং আর আকাশের অবয়ব যেনো 'অ্যাকে অ্যাকে দুইয়ে' মিলে গেছে। আকাশ আর সমুদ্র পার্থক্য করা কঠিন হয়ে যেত যদি সীমান্ত রেখাখানী মেঘমালায় ধূসর না হতো। বেশ চমৎকার একটি দৃশ্য। তবে মেঘের দলে ভাসতে ভাসতে আধ আকাশ অবদি ছড়িয়ে বৃষ্টিতে পুরো সাগর পথ যেনো এক মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। মাঝে পড়ে থাকা জাহাজটি শুধু ভয়ংকর দোল খাচ্ছে। একবার ডানে থেকে একবার বামে এমন ভাবেই দুলছিল বোধয় এই না যেনো, পড়ে-ডুবে পুরো ভিডিওর রিয়্যাকশন ওয়াও থেকে স্যাড হয়ে যায়। এত মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ন ন্যাচারাল ডিসাস্টারের মধ্যে ফিশারম্যান গুলো খুবই কৌশলে তারা বিরাট বিরাট আকারের সোনালী রূপালী রঙের মাছ তুলে বেড়াচ্ছিল পুরো সাগল জলে। একটি মাছ ক্যামেরায় এমন ভাবেই ধরেছিল যে মনে হয়েছে; সূর্য তার রশ্মি দিয়ে মেঘ ছিদ্র করে ওই মাছের গা আলোকিত করে দিয়েছে। তাই স্যালমনটির সোনালী স্কিন জল জল করে ঝিকিমিকি আলোর কিরণে চকচক করছিল। কি-যে, মনোমুগ্ধকর সি - অ্যাডভেঞ্চার দৃশ্যপট মুখে বলে বোঝানো কঠিন!
তবে ভিডিওটি খুঁজে পাচ্ছি না বলে লিংক দিতে পারলাম না। সরি।
২ দিন পার হয়ে গেছে। কিন্তু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি বিষয়টি। কারণ এত্ত সুন্দর করে স্যালমন ধরার দৃশ্য যেনো আমার চোখে না লেগে মনে বেঁধে গেছে। মনে বাঁধবার একটি বড় সড় সাইকোলজিও আছে। আমি গত ২ দিন আগে লঞ্চে করে বরিশালের উদ্দেশ্যে রওনা হই। আমার কেবিনটা সাদা মাটা ডাবল বেডের একটি এসি কেবিন। ডাবল কেবিন হবার কারণ আমার 'মা'। আমি রাত ১১ টার খাবারের পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখলাম আম্মু ডানে মুড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই ভাবলাম এটাই সময়;- একটু ভেপিং করে আসি। কেবিন খুলেই আমাদের খোলা রেলিংয়ের বারান্দা। সেখান থেকে যে কেউ চাইলেই সুইসাইড করতে পারবে নিজ ইচ্ছায় নদী বাছাই করে করে। যেমন, পদ্মা, মেঘনা, কিংবা যমুনা। আমি ভেপিং শেষে রুমে গিয়ে নেটফ্লিক্সের রাশিয়ান অ্যাকশন ড্রামা ফিল্ম "ব্ল্যাক ক্র্যাব" দেখতে বসে গিয়েছিলাম। কিন্তু মুভিটি একবারে শেষ করতে পারলাম নাহ। অর্ধেকটা দেখে ফির বারান্দায় গিয়ে রেলিংয়ের চেয়ারে বসে ভেপিং করতে করতে ফেসবুক দেখছিলাম। তখন লঞ্চ খানিকটা বেশ দুলছিল। দেখলাম ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শন শন শব্দের সাথে বয়ে বেড়াচ্ছে। দূরে দূরে বিশাল বিশাল শব্দহীন বিদ্যুৎ চমকানোর ঝলকানি লক্ষ করলাম, বেশ কয়েকটা। খুবই বাতাস ছেড়েছে। কিন্তু রুমে ঢোকা যাবে নাহ। যতই ভয় করুক রুমে ঢুকলেই এই আবহাওয়া মিস! আর তাছাড়াও মোবাইল ডেটা চলবে না। তাই ফিলিংস নিতে লাগলাম প্রকৃতির। যদিও ভয় হচ্ছিল খুব বেশি যে, পড়লেই ২ সেকেন্ডের মধ্যে আমি মারা যাব আল্লাহ চাইলে। কারণ আমি সাঁতার জানি নাহ ( সাঁতার না জানার ফলে সাইকোলজিক্যালি মানুষকে বেশি দুর্বল করে তোলে পানিতে নামতে)। কিন্তু সাহস এঁটে বসে বসে প্রকৃতি দেখতে লাগলাম আর ফেসবুক ঘাটতে লাগলাম। কয়েকটি নিউজ পড়ে ভিডিওতে গিয়েই পেলাম সেই "স্যালমন ধরার" রোমাঞ্চকর মনোরম অ্যাডভেঞ্চার ভিডিওটি।
আজ আমি ঢাকায় ঘরে বসে খুব খুঁজেছি ভিডিওটি। পেলাম নাহ। কিন্তু অনলাইনে উক্ত ভিডিওটি খুঁজে না পাওয়ার জন্য নিজের হার নিজের থেকে লুকানোর জন্য ইউটিউবে সার্চ করতে লাগলাম- "হাউ টু ফিলেট স্যালমন ফিশ", "জাপানিজ কাটিং ওয়ে অব হোল স্যালমন ফিশ" ইত্যাদি। এভাবে কয়েকটি ভিডিও দেখে মাছ কাটার সুন্দর সুন্দর কৌশল পর্যবেক্ষণ করলাম দৃর আবেগের সাথে। তারপর দেখলাম স্যালমন ফিশের রেসিপি। প্রায় সব রেসিপির মধ্যে কমনলি ফেমাস হলো;- "গার্লিক লেমনড গ্রীলড স্যালমন"। সাথে সাথেই ডিসাইড করলাম আমি এটা বানাবো। আর পরিবেশন করবো সাদা ভাত কচলিয়ে বল বল বানিয়ে ('রাইস বল') জাপানিজ নাম দিয়ে।
মিষ্টি বিকেলে শুয়ে শুয়ে ভাবলাম রেসিপিটি পরিবেশন করে বাসার সবার থেকে একটা লং টাইম অ্যাটেনশন সিক করবো। তাই আজ বাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলাম স্যালমন খুঁজতে। কিন্তু আমাদের এই আরামবাগ বাজার থেকে মিরপুর ৬ তারপর ঘুরতে ঘুরতে ১ নম্বর বাজারে গিয়ে চিরুনি তল্লাশি দিয়েও পায়নি স্যালমন ফিশ। কিন্তু কোরাল, সুরমা, রূপচাঁদা ছাড়াও নানান মাছ ছিল বাজারে। ফিরে আসলাম রাত ৮ টার দিকে এক হতাশার ছাপ চেহারায় মেখে। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম কোন বাজারে গিয়ে ফ্রেশ স্যালমন কেনা যায়?
কিন্তু অতদূর যাওয়ার ইচ্ছেও নেই। আমি বেশ অলস প্রবল মানুষ বলেই হয়তো দূরের কোথাও যাওয়ার চিন্তা ছেড়ে দেই অতি দ্রুত। অনলাইনে খুঁজতে লাগলাম স্যালমন ফিশ। ২টি ভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে মাছটি পেলাম। কিন্তু আমি আবারও হতাশ এবং একই সাথে কনফিউজড। সি ফিশ বিডি নামক ওয়েবে দেখলাম ইন্ডিয়ান স্যালমন এর দাম ১২০০ টাকা আর নরওয়ের স্যালমন এর দাম দেয়া ৭০০০ টাকার মতন। ঠিক একই রকম ভাবে কাবলিওয়ালা ওয়েবেও ইন্ডিয়ান স্যালমনের দাম ১২০০ টাকা এবং নরওয়ের স্যালমন ৫ কেজি ফিলেটেড ১২,০০০ টাকা। ভ্রু কুচকে গেলো আমার।
কিন্তু আমি প্রাইস এর ডিফারেন্স দেখে বেশি অবাক হইনি। কারণ আমাদের দেশে ইমপোর্টেড যে কোনো কিছুর জিনিসই আকাশ ছোঁয়া দাম দর করা হয়। তাই আমি অবাক হয়েছি দুটি আলাদা স্যালমন দেখে। তাই ইউটিউব থেকে রিসার্চ করে দেখতে পেলাম প্যাসিফিক অসিয়ান ও আটলান্টিক অসিয়ানের স্যালমন মধ্যকার পার্থক্য। জানতে পারলাম স্যালমন ফিশ একধরনের এনাট্রমাস জাতীয় মাছ। বিস্তারিত ভাষায়, এটি আমাদের ইলিশের মতন মিঠা পানিতে জন্ম নেয়, সাগরের নোনা জলে বিকশিত হয়ে আবার মিঠা পানিতে প্রজননের জন্য চলে আসে। এই সাইকেলে স্যালমন ফিশ সাধারণত হাজারো মাইল পারি দিয়ে থাকে। লোকে মুখে আছে যে, স্যালমন যেখান থেকে জন্ম নেয় প্রজননের সময় ঠিক সেখানেই চলে যায়। কিন্তু এটি অবিশ্বাস ভাবে সাইন্টিফিক ট্র্যাকিং সিস্টেমে দেখা গেছে এটি সত্য সম্ভব একটি সংলাপ। যাই হোক আসল কথায় আসা যাক। স্যালমন ফিশ সাধারণত দুটি মহাসাগরে অবস্থানরত আছে। একটি 'আটলান্টিক মহাসাগর' অপরটি 'প্রশান্ত মহাসাগর'। কিন্তু অবাক করা বিষয় আটলান্টিক মহাসাগরে থাকা স্যালমন জাত কেবল একটিই যেখানে প্রশান্ত মাহআসাগরের স্যালমনের জাত প্রায় ৭-৮ প্রকার। প্রশান্তমহাসাগরীয় ভূগোলে প্রায় ২০টিরও বেশি সাগর রয়েছে। যেখানে এশিয়ান সিও সারিবদ্ধভাবে অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বেশির ভাগ এশিয়ান সি আবার ইন্ডিয়ান অসিয়ানের সাথে যুক্ত হয়ে প্রশান্ত সাগরে গিয়ে মিলেছে। বিষয়টি কিছুটা কমপ্লেক্স।
তো আমি ভাবতে লাগলাম, তাহলে কি স্যালমন জাত ভেদে আমি ইন্ডিয়ান স্যালমন বিরূপ আকার আকৃতির পাবো কি না? রিসার্চ করে দেখলাম ইন্ডিয়ান স্যালমন সাধারণত বঙ্গোপসাগর সাগর হয়ে মিঠা নদীর তলদেশে এসে ডিম ছাড়তে গিয়ে আটকে যায় অথবা সাগর দেশে মারা যায়। কিন্তু এদের জিনগত বৈশিষ্ট্য সর্বদা সকল স্যালমন জাতের জন্য একই প্রযোজ্য বিষয়। যেমন: এদের বয়স সাধারণত ৩-৮ বছরের, এর সবাই মিঠা পানিতে প্রজনন ঘটায় ইত্যাদি ইত্যাদি। স্যালমন ফিশের জন্ম থেকে প্রজননের জীবন চক্রের আলাপ এখানে লেখার তেমন বিরল চাহিদা নেই বলে ইতিবাচভাবেই আমি তা এড়িয়ে যাচ্ছি। এখানে আমার উৎবিগ্ন হয়ে লেখার মূল কারণ ছিল দুটি ভিন্ন ভিন্ন জাতের স্যালমন। তাই আমি স্যালমন জীবন চক্র এড়িয়ে যাওয়াটাই বেশ মনে করেছি। আমি রিসার্চ করে বেশ কিছু তথ্য থেকে অবশেষে জানলাম ঠিক যেমন আমাদের দেশের পদ্মা নদীর ইলিশের সাথে পৃথিবীর কোনো সাগরের হিলশা ফিশ কিংবা ইন্ডিয়ার নদীর ইলিশের কোনো তুলনা হয়না; তেমনি ভাবে আটলান্টিক অসিয়নের স্যালমনের সাথে প্যাসিফিক অসিয়ানের স্যালমনেরও কোনো তুলনা হয়না। শুধু মাত্র আটলান্টিক মহাসাগরের একটি মাত্র স্যালমন জাত পৃথিবী জুড়ে সু-সাদে রাজকীয় মুকুট নিয়ে দেশে বিদেশে সুনাম ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। যদিও আরো ৬-৮ প্রকার স্যালমন নানান দেশে চাহিদার সাথে কেনা বেচা হচ্ছে। বিষয়টা আমি বেশ বুঝতে পেরেছি কল্পনায়, ভারতীয় ইলিশের সাথে দেশীয় ইলিশের একটি কলকাতার তুলনামূলক ভিডিওর কথার স্মরণে। তাই মন বুঝে গেলো যত যাই হোক, সে আটলান্টিক সাগরের স্যালমন খেতে হলে নরওয়ের স্যালমনই খেতে হবে। অন্য স্যালমন কখনোই এক হবে না। তাই আস্ত স্যালমন ইমপোর্ট করবার একটি ওয়েব থেকে রিকুয়েস্ট করতে গিয়ে জানলাম প্রায় বাংলাদেশী টাকায় ২০,০০০ টাকা ফুল অ্যাডভান্সড করতে হবে ৬-৮ কেজির একটি আস্ত স্যালমন মাছের জন্য। বাস্তবতায় ফিরে আসলাম তৎক্ষণাৎ। আমি তৌহিদ আফ্রিদী নই যে আমার পরিবারের অনেক টাকা আছে আর না আমি ইফতেখার রাফসানের মতন একজন সফল ফুড ব্লগার যে আমায় স্পন্স করে মাছ আনিয়ে দিবে থার্ড পার্টি। এক বুক দুঃখ নিয়ে নিজেকে বোঝালাম যে, আমি তো মাছ খাই না।
0 comments
Be the first to comment!
This post is waiting for your feedback.
Share your thoughts and join the conversation.