______সূরা নাসের আলোচনা______
قُلۡ اَعُوۡذُ بِرَبِّ النَّاسِ ۙ
মুফতী তাকী উসমানী
বল, ১ আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি সমস্ত মানুষের প্রতিপালকের
মাওলানা মুহিউদ্দিন খান
বলুন, আমি আশ্রয় গ্রহণ করিতেছি মানুষের পালনকর্তার,
ইসলামিক ফাউন্ডেশন
বল, ‘আমি শরণ নিচ্ছি মানুষের প্রতিপালকের,
—আন নাস - ১
مَلِکِ النَّاسِ ۙ
মুফতী তাকী উসমানী
সমস্ত মানুষের অধিপতির
মাওলানা মুহিউদ্দিন খান
মানুষের অধিপতির,
ইসলামিক ফাউন্ডেশন
‘মানুষের অধিপতির,
—আন নাস - ২
اِلٰہِ النَّاسِ ۙ
মুফতী তাকী উসমানী
সমস্ত মানুষের মাবূদের ২
মাওলানা মুহিউদ্দিন খান
মানুষের মা’বুদের
ইসলামিক ফাউন্ডেশন
‘মানুষের ইলাহের নিকট
—আন নাস - ৩
مِنۡ شَرِّ الۡوَسۡوَاسِ ۬ۙ الۡخَنَّاسِ ۪ۙ
মুফতী তাকী উসমানী
সেই কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট হতে, যে পেছনে আত্মগোপন করে ৩
মাওলানা মুহিউদ্দিন খান
তার অনিষ্ট থেকে, যে কুমন্ত্রণা দেয় ও আত্নগোপন করে,
ইসলামিক ফাউন্ডেশন
আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট হতে’
—আন নাস - ৪
الَّذِیۡ یُوَسۡوِسُ فِیۡ صُدُوۡرِ النَّاسِ ۙ
মুফতী তাকী উসমানী
যে মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়,
মাওলানা মুহিউদ্দিন খান
যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে
ইসলামিক ফাউন্ডেশন
‘যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে,
—আন নাস - ৫
আন নাস, আয়াতঃ ৬
مِنَ الۡجِنَّۃِ وَالنَّاسِ ٪
অর্থঃ
মুফতী তাকী উসমানী
সে জিনদের মধ্য হতে হোক বা মানুষের মধ্য হতে। ৪
মাওলানা মুহিউদ্দিন খান
জ্বিনের মধ্য থেকে অথবা মানুষের মধ্য থেকে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন
‘জিনের মধ্য হতে এবং মানুষের মধ্য হতে।’
---------------------
শানে নুজুলঃ ‘খান্না-স’ সে শয়তান, যার অভ্যাস হল, আল্লাহকে স্মরণকালে সে দূরে সরে যায় । আর বান্দাহ গাফেল হলে সে এসে কু-প্ররোচনা দেয় । (বুখারী)
---------------------
তাফসীর (মুফতী তাকী উসমানী) (Bangla)
৪. সূরা আনআমে (৬ : ১১২) বলা হয়েছে, শয়তান যেমন জিন্নদের মধ্যে হয়, তেমনি মানুষের মধ্যেও হয়। তবে জিন্ন শয়তানদেরকে চোখে দেখা যায় না। তারা অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়। আর মানুষ শয়তানদেরকে চোখে দেখা যায়। তারা এমন সব কথাবার্তা বলে, যা শুনলে অন্তরে নানা রকমের কুচিন্তা জাগ্রত হয়। তাই এ আয়াতে উভয় রকম কুমন্ত্রণাদাতা থেকে আল্লাহ তাআলার আশ্রয় চাওয়া হয়েছে। এ সূরায় যদিও শয়তানের কুমন্ত্রণা দেওয়ার শক্তির কথা জানানো হয়েছে, কিন্তু সেই সঙ্গে আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় প্রার্থনার নির্দেশ দিয়ে এটাও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলার কাছে পানাহ চাইলে এবং তাঁর যিকির করলে শয়তান দূরে সরে যায়। সূরা নিসায়(৪ : ৭৬) বলা হয়েছে, তার কৌশল দুর্বল এবং তার এ শক্তি নেই যে, মানুষকে গুনাহ করতে বাধ্য করবে। সূরা ইবরাহীমে (১৪ : ২২) খোদ শয়তানের স্বীকারোক্তি বর্ণনা করা হয়েছে যে, ‘মানুষের উপর আমার কোন আধিপত্য নেই’। বস্তুত শয়তান যে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করে এটা মানুষের জন্য এক পরীক্ষা। যে ব্যক্তি তার ধোঁকায় পড়তে অস্বীকার করে এবং এজন্য আল্লাহ তাআলার কাছে পানাহ চায়, শয়তান তার কোন ক্ষতি করতে পারে না।
কুরআন মাজীদের সূচনা হয়েছিল সূরা ফাতিহা দ্বারা। তাতে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা ও গুণাবলী উল্লেখ করার পর তাঁরই কাছে সরল পথের হেদায়াত দান করার জন্য দোয়া করা হয়েছিল। এবার সমাপ্তি টানা হয়েছে সূরা ‘নাস’ দ্বারা। এতে শয়তানের অনিষ্ট থেকে পানাহ চাওয়া হয়েছে। এভাবে সরল পথে চলার ক্ষেত্রে শয়তানের পক্ষ হতে যে বাধার সৃষ্টি হতে পারত, তা অপসারণের পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে নফস ও শয়তান উভয়ের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করুন আমীন।
---------------------
তাফসীরে মাআ'রিফুল কুরআন (Bangla)
সম্পূর্ন সূরার তাফসীরঃ
তাফসীরের সার-সংক্ষেপঃ
আপনি বলুন, আমি মানুষের মালিক, মানুষের অধিপতির এবং মানুষের মাবুদের আশ্রয় গ্রহণ করছি তার (অর্থাৎ সেই শয়তানের) অনিষ্ট থেকে যে কুমন্ত্রণা দেয় ও পশ্চাতে সরে যায়, (হাদীসে আছে, আল্লাহর নাম উচ্চারণ করলে শয়তান সরে যায়। এখানে উদ্দেশ্য তাই)। যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে জিনের মধ্য থেকে অথবা মানুষের মধ্য থেকে। (অর্থাৎ আমি যেমন শয়তান জিন থেকে আশ্রয় গ্রহণ করছি, তেমনি শয়তান মানুষ থেকেও আশ্রয় গ্রহণ করছি। কোরআনের অন্যত্র আছে যে, মানুষ ও জিন উভয়ের মধ্য থেকে শয়তান হয়ে থাকে :
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ
আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষযঃ
সূরা ফালাকে জাগতিক বিপদাপদ থেকে আশ্রয় প্রার্থনার শিক্ষা রয়েছে। আলোচ্য
সূরা নাসে পারলৌকিক আপদ ও মুসীবত থেকে আশ্রয় প্রার্থনার প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। যেহেতু পরকালীন ক্ষতি গুরুতর, তাই এর প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে কোরআন পাক সমাপ্ত করা হয়েছে।
قل أعُوذُ بِرَبِّ النّاسِ
এখানে ناس-এর দিকে এবং পূর্ববর্তী সূরায় فلق এর দিকে رب-এর সম্বন্ধ করা হয়েছে। কারণ এই যে, পূর্ববর্তী সূরায় বাহ্যিক ও দৈহিক বিপদাপদ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা উদ্দেশ্য এবং সেটা মানুষের মধ্যে সীমিত নয়। জন্তু-জানোয়ারও দৈহিক বিপদাপদ এবং মুসীবতে পতিত হয়। কিন্তু সূরায় শয়তানী কুমন্ত্রণা থেকে আশ্রয় প্রার্থনার কথা বলা হয়েছে। এটা মানুষের মধ্যে সীমিত এবং জিন জাতিও প্রসঙ্গত শামিল আছে। তাই এখানে رب শব্দের সম্বন্ধناس -এর দিকে করা হয়েছে।(বায়যাভী)
مَلِكِ النَّاسِ
মানুষের অধিপতি, إِلهِ النَّاسِ --মানুষের মাবুদ। এদু’টি গুণ সংযুক্ত করার কারণ এই যে, ) শব্দটি কোন বিশেষ বস্তুর দিকে সম্বন্ধ হলে আল্লাহ্ ব্যতীত অপরের জন্যও ব্যবহৃত হয়; যথা رب الدار গৃহের মালিক। প্রত্যেক মালিকই অধিপতি হয় না। তাইمَلِكِ النَّاسِ বলা হয়েছে। অতঃপর প্রত্যেক অধিপতিই মাবুদ না। তাইإِلهِ النَّاسِ বলতে হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ্ মালিক, অধিপতি,
মাবুদ সবই। এই তিনটি গুণ একত্র করার রহস্য এই যে, এগুলোর মধ্যে প্রত্যেকট শুগ হিফাযত সংরক্ষণ দাবী করে। কেননা, প্রত্যেক মালিক তার মালিকানাধীন বস্তুর, প্রত্যেক রাজা তার প্রজার এবং প্রত্যেক উপাস্য তার উপাসকদের হিফাযত করে। এই গুণত্রয় একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার মধ্যে একত্রিত আছে। তিনি ব্যাতীত কেউ এই গুণন্নয়ের সমষ্টি নন। তাই আল্লাহ্ তা’আলার আশ্রয় সর্বাধিক বড় আশ্রয়। আল্লাহ্, আপনিই এসব গুণের আধার এবং আমরা কেবল আপনার কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করি—এভাবে দোয়া করলে তা কবুল হওয়ার নিকটবর্তী হবে। এখানে প্রথমেمَلِكِ النَّاسِ বলার পর ব্যাকরণিক নীতি অনুযায়ী সর্বনাম ব্যবহার করে ملكهم ও المهم বলাই সঙ্গত ছিল। কিন্তু দোয়া ও প্রশংসার স্থল হওয়ার কারণে একই শব্দকে বার বার উল্লেখ করাই উত্তম বিবেচিত হয়েছে। কেউ কেউ এ শব্দটি বার বার উল্লেখ করার ব্যাপারে একটি রসালতত্ত্ব বর্ণনা করেছেন। তাঁরা বলেনঃ এ সূরায় ناس শব্দ পাঁচ বার উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম ناس বলে অল্পবয়স্ক বালক বালিকা বোঝানো হয়েছে। একারণেই এর আগেرب অর্থাৎ পালনকর্তা শব্দ আনা হয়েছে। কোন অল্পবয়স্ক ভালো বালিঘাই প্রতিপালকের অধিক মুখাপেক্ষী। দ্বিতীয় ناس ধারা যুবক শ্রেণী বুঝানো হয়েছে।ملك (রাজা, শাসক) শব্দ এর ইঙ্গিত বহন করে। কেননা শাসন যুবকদের জন্য উপযুক্ত। তৃতীয় ناس বলে সংসার ত্যাগী এবাদতে মশগুল বুড়ো শ্রেণীকে বুঝানো হয়েছে। ইবাদতের অর্থ বাহি ইলাহ শব্দ তাদের জন্য উপযুক্ত। চতুর্থ ناس বলে আল্লাহর সৎকর্মপরায়ন বান্দা বোঝানো হয়েছে।
وسوسه
শব্দ এর ইঙ্গিত বহন করে। কেননা শয়তান সৎকর্মপরায়ণদের শত্রু। তাদের অন্তরে কুমন্ত্রণা সৃষ্টি করাই তার কাজ। পঞ্চম বলে ناس দুষ্কৃতকারী লোক বুঝানো হয়েছে। কেননা তাদের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়েছে।
مِنْ شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ
যে বিষয় থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা উদ্দেশ্য অত্র আয়াতে সেই বিষয় বর্ণিত হয়েছে। وسواس শব্দটি ধাতু। এর অর্থ কুমন্ত্রণা। এখানে অতিরঞ্জনের নিয়মে শয়তানকেই কুমন্ত্রণা বলে দেওয়া হয়েছে। সে যেন আপাদ মস্তক কুমন্ত্রণা। আওয়াজহীন গোপন বাক্যের মাধ্যমে শয়তান মানুষকে তার আনুগত্যের আহ্বান করে। মানুষ এই বাক্যের অর্থ অনুভব করে কিন্তু কোন আওয়াজ শুনে না। শয়তানের এরূপ আহবানকে কুমন্ত্রণা বলা হয়। (কুরতুবী) خناس শব্দটি خنس থেকে উৎপন্ন। অর্থ পশ্চাতে সরে যাওয়া। মানুষ আল্লাহর নাম উচ্চারণ করলে পিছনে সরে যাওয়াই শয়তানের অভ্যাস। মানুষ গাফিল হলে শয়তান আবার অগ্রসর হয়। অতঃপর হুঁশিয়ার হয়ে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করলে শয়তান আবার পশ্চাতে সরে যায়। এ কার্যধারাই অবিরাম অব্যাহত থাকে। রসূলুল্লাহ (সা) বলেনঃ প্রত্যেক মানুষের অন্তরে দুটি গৃহ আছে। একটিতে ফেরেশতা ও অপরটিতে শয়তান বাস করে। (ফেরেশতা সৎ কাজে এবং শয়তান অসৎ কাজে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে )। মানুষ যখন আল্লাহর যিকির করে, তখন শয়তান পিছনে সরে যায় এবং যখন যিকিরে থাকে না, তখন তার চঞ্চু মানুষের অন্তরে স্থাপন করে কুমন্ত্রণা দিতে থাকে।---(মাযহারী)
مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ
অর্থাৎ কুমন্ত্রণাদাতা জিনের মধ্য থেকেও হয় এবং মানুষের মধ্য থেকেও হয়। অতএব সারমর্ম এই দাঁড়াল যে, আল্লাহ তা’আলা রসূলকে তাঁর আশ্রয় প্রার্থনার শিক্ষা দিয়েছেন জিন শয়তানের অনিষ্ট থেকে এবং মানুষ শয়তানের অনিষ্ট থেকে। এখন জিন শয়তানের কুমন্ত্রণা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কারণ তারা অলক্ষ্যে থেকে মানুষের অন্তরে কোন কথা রাখতে পারে। কিন্তু মানুষ শয়তান প্রকাশ্যে সামনে এসে কথা বলে। এটা কুমন্ত্রণা কিরূপে হল? জওয়াব এই যে, মানুষ শয়তানও কারও সামনে এমন কথা বলে, যা থেকে সেই ব্যক্তির মনে কোন ব্যাপার সম্পর্কে সন্দেহ ও সংশয় মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এই সন্দেহ ও সংশয়ের বিষয় সে পরিষ্কার বলে না। শায়খ ইয়মুদ্দীন (র) তদীয় গ্রন্থে বলেন: মানুষ শয়তানের অনিষ্ট বলে নফসের ( মনের) কুমন্ত্রণা বোঝানো হয়েছে। কেননা, জিন শয়তান যেমন মানুষের অন্তরে কু-কাজের আগ্রহ সৃষ্টি করে তেমনি স্বয়ং মানুষের নফসও মন্দ কাজেরই আদেশ করে। একারণেই রসুলুল্লাহ (সা) আপন নফসের অনিষ্ট থেকেও আশ্রয় প্রার্থনা শিক্ষা দিয়েছেন। হাদীসে আছে اللهم اعوذ بك من شر نفسي ومن شر الشيطان وشركه – অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি আপনার আশ্রয় চাই, আমার নফসের অনিষ্ট থেকে, শয়তানের অনিষ্ট থেকে এবং শিরক থেকেও।
শয়তানী কুমন্ত্রণা থেকে আশ্রয় প্রার্থনার গুরুত্ব অপরিসীম: ইবনে কাসীর বলেনঃ এ সূরার শিক্ষা এই যে, পালনকর্তা, অধিপতি, মাবুদ---আল্লাহ্ তা’আলার এই গুণত্রয় উল্লেখ করে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা মানুষের উচিত। কেননা প্রত্যেক মানুষের সাথে একটি করে শয়তান লেগে আছে। সে প্রতি পদক্ষেপে মানুষকে ধ্বংস ও বরবাদ করার চেষ্টায় ব্যাপৃত থাকে। প্রথমে তাকে পাপ কাজের প্রতি উৎসাহিত করে এবং নানা প্রলোভন দিয়ে পাপ কাজের দিকে নিয়ে যায়। এতে সফল না হলে মানুষের সৎকর্ম ও ইবাদত বিনষ্ট করার জন্য রিয়া, নাম-যশ, গর্ব ও অহংকার অন্তরে সৃষ্টি করে দেয়। বিদ্বান্ লোকদের অন্তরে সত্য বিশ্বাস সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টির চেষ্টা করে। অতএব, শয়তানের অনিষ্ট থেকে সে-ই বাঁচতে পারে যাকে আল্লাহ্ বাঁচিয়ে রাখেন।
রসূলুল্লাহ্ (সা) বলেন: তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যার উপর তার সঙ্গী শয়তান চড়াও হয়ে না আছে। সাহাবায়ে কিরাম আরয করলেনঃ ইয়া রসূলাল্লাহ্! আপনার সাথেও এই সঙ্গী আছে কি? উত্তর হল হ্যাঁ, কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা শয়তানের মুকাবিলায় আমাকে সাহায্য করেন। এর ফলশ্রুতিতে শয়তান আমাকে সদুপদেশ ব্যতীত কিছু বলে না।
হযরত আনাস (রা)-এর হাদীসে আছে, একবার রসূলুল্লাহ্ (সা) মসজিদে এতে কাফরত ছিলেন। এক রাত্রিতে উম্মুল মু’মিনীন হযরত সফিয়্যা (রা) তাঁর সাথে সাক্ষ তের জন্য মসজিদে যান। ফেরার সময় রসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁর সাথে রওয়ানা হলেন। গলিপথে চলার সময় দু’জন আনসারী সাহাবী সামনে পড়লে রসূলুল্লাহ্ (সা) আওয়াজ দিলেন, তোমরা আস। আমার সাথে আমার সহধমিনী সফিয়্যা বিনতে হুয়াই (রা) রয়েছেন। সাহাবীদ্বয় সম্ভ্রমে আরয করলেনঃ সোবহানাল্লাহ্ ইয়া রসূলাল্লাহ্, (অর্থাৎ আপনি মনে করেছেন যে, আমরা কোন কুধারণা করব)। রসূলুল্লাহ্ (সা) বললেনঃ নিশ্চয়ই। কারণ, শয়তান মানুষের রক্তের সাথে তার শিরা-উপশিরায় প্রভাব বিস্তার করে। আমি আশংকা করলাম যে, শয়তান তোমাদের অন্তরে আমার সম্পর্কে কু-ধারণা সৃষ্টি করতে পারে। তাই আমি বলে দিয়েছি যে, আমার সাথে কোন বেগানা নারী নেই।
নিজে মন্দ কাজ থেকে বেঁচে থাকা যেমন জরুরী, তেমনি অন্য মুসলমানকে নিজের ব্যাপারে কু-ধারণা করার সুযোগ দেওয়াও দুরস্ত নয়। মানুষের মনে কু-ধারণা সৃষ্টি হয়—এ ধরনের আচরণ থেকে বেঁচে থাকা উচিত। এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে গেলে পরিষ্কার কথার মাধ্যমে অপবাদের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া সঙ্গত। সারকথা এই যে, উপরোক্ত হাদীস প্রমাণ করেছে যে, শয়তানী কুমন্ত্রণা অত্যধিক বিপজ্জনক ব্যাপার।
আল্লাহর আশ্রয় ব্যতীত এ থেকে আত্মরক্ষা করা সহজ নয়। এখানে যে কুমন্ত্রণা থেকে সতর্ক করা হয়েছে, এটা সেই কুমন্ত্রণা, যাতে মানুষ স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে মশগুল হয়। অনিচ্ছাকৃত কুমন্ত্রণা ও কল্পনা, যা অন্তরে আসে এবং চলে যায়- সেটা ক্ষতিকর নয় এবং তজ্জন্য কোন গোনাহ হয় না।
সূরা ফালাক ও সূরা নাস-এর আশ্রয় প্রার্থনার মধ্যে একটি পার্থক্য : সূরা ফালাকে যার আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়েছে (অর্থাৎ আল্লাহর), তার মাত্র একটি বিশেষণرب الفلق উল্লেখ করা হয়েছে এবং যেসব বিষয় থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়েছে, সেগুলো অনেক বর্ণিত হয়েছে। সেগুলো প্রথমে من شر ما خلقবাক্যে সংক্ষেপে এবং পরে তিনটি বিশেষ বিপদের কথা আলাদা উল্লেখ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে সূরা নাসে যে বিষয় থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়েছে, তা তো মাত্র একটি। অর্থাৎ কুমন্ত্রণা এবং যার আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়েছে, তার তিনটি বিশেষণ উল্লেখ করে দোয়া করা হয়েছে। এথেকে জানা যায়। যে, শয়তানের অনিষ্ট সর্ববৃহৎ অনিষ্ট। প্রথমত এ কারণে যে, অন্য আপদ-বিপদের প্রতিক্রিয়া মানুষের দেহ ও পার্থিব বিষয়াদিতে প্রতিফলিত হয়, কিন্তু শয়তানের অনিষ্ট মানুষের ইহকাল ও পরকাল উভয়কে বিশেষত পরকালকে বরবাদ করে দেয়। তাই এ ক্ষতি গুরুতর। দ্বিতীয়ত দুনিয়ার আপদ-বিপদের কিছু না কিছু বৈষয়িক প্রতিকারও মানুষের করায়ত্ত আছে এবং তা করা হয়ে থাকে, কিন্তু শয়তানের মুকাবিলা করার কোন বৈষয়িক কৌশল মানুষের সাধ্যাতীত ব্যাপার। সে মানুষকে দেখে, কিন্তু মানুষ তাকে দেখে না। সুতরাং এর প্রতিকার একমাত্র আল্লাহর যিকির ও তাঁর আশ্রয় গ্রহণ করা।
মানুষের শত্রু মানুষও এবং শয়তানওঃ এই শত্রুদ্বয়ের আলাদা আলাদা প্রতিকার : মানুষের শত্রু মানুষও এবং শয়তানও। আল্লাহ্ তা’আলা মানুষ শত্রুকে প্রথমে সচ্চরিত্র, উদার ব্যবহার, প্রতিশোধ বর্জন ও সবরের মাধ্যমে বশ করার শিক্ষা দিয়েছেন। যদি, সে এতে বিরত না হয়, তবে তার সাথে জিহাদ ও যুদ্ধ করার আদেশ দান করেছেন। কিন্তু শয়তান শত্রুর মুকাবিলা কেবল আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনার মাধ্যমে করার শিক্ষা দিয়েছেন। ইবনে কাসীর তাঁর তফসীরের ভূমিকায় তিনটি আয়াত উল্লেখ করেছেন। আয়াতে মানুষের উপরোক্ত শত্রুদ্বয়ের উল্লেখ করার পর মানুষ শত্রুর প্রতিরক্ষায় সচ্চরিত্রতা, প্রতিশোধ বর্জন ও সদয় ব্যবহার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং শয়তান-শত্রুর প্রতিরক্ষায় কেবল আশ্রয় প্রার্থনার সবক দেওয়া হয়েছে। ইবনে কাসীর বলেনঃ সমগ্র কোরআনে এই বিষয়বস্তুর মাত্র তিনটি আয়াতই বিদ্যমান আছে। সূরা আ’রাফের এক আয়াতে প্রথমে বলা হয়েছে خُذ الْعَفو وامْر بِالْمَعْرُوفِ واعرض عَن الْجَاهِلين এর অর্থ এইযে ক্ষমা ও মার্জনা সৎ কাজের আদেশ এবং তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মানুষ শত্রুর মোকাবেলা কর। এই আয়াতেই অতঃপর বলা হয়েছে وَإِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنْ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ إِنَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ এতে শয়তান শত্রুর মোকাবেলা করার কৌশল শিক্ষা দেয়া হয়েছে। যার সারকথা আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করা। দ্বিতীয় সূরা কাজ আফলাহাল মুমিনুনে প্রথমে মানুষ শত্রুর মোকাবেলা প্রতিকার বর্ণনা করেছেনঃ ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ অর্থাৎ মন্দকে ভালো ধারা পরিণত করা| অতঃপর শয়তান শত্রুর মোকাবেলা জন্য বলেছেনঃ وَقُلْ رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزاتِ الشَّياطِينِ - وَأَعُوذُ بِكَ رَبِّ أَنْ يَحْضُرُونِ অর্থাৎ হে আমার পালনকর্তা আমি আপনার কাছে চাই শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে এবং তাদের আমার কাছে আসা থেকে। তৃতীয় আয়াত সূরা হা-মীম সেজদাহ প্রথমে মানুষ শত্রু কে প্রতিহত করার জন্য বলা হয়েছে।
ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ
অর্থাৎ তুমি মন্দকে ভালো দ্বারা প্রতিহত করো। এরূপ করলে দেখবে যে তোমার শত্রু
তোমার বন্ধুতে পরিণত হবে। এ আয়াতেই পরবর্তী অংশে শয়তান শত্রুর মোকাবেলা জন্য বলা হয়েছে وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ এটা প্রায় সূরা আরাফেরই অনুরূপ আয়াত। এর সারমর্ম এই যে শয়তান শত্রুর মোকাবেলা আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা ছাড়া কিছুই নয়।
উপরোক্ত তিনটি আয়াতেই মানুষ শত্রুর প্রতিকার ক্ষমা, মার্জনা ও সচ্চরিত্রতা বর্ণিত হয়েছে। কেননা, ক্ষমা ও অনুগ্রহের কাছে নতিস্বীকার করাই মানুষের স্বভাব। আর যে নরপিশাচ মানুষের প্রকৃতিগত যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে, তার প্রতিকার জিহাদ ও যুদ্ধ ব্যক্ত হয়েছে। কেননা, সে প্রকাশ্য শত্রু, প্রকাশ্য হাতিয়ার নিয়ে সামনে আসে। তার শক্তির মুকাবিলা শক্তি দ্বারা করা সম্ভব। কিন্তু অভিশপ্ত শয়তান স্বভাবগত দুষ্ট। অনুগ্রহ, ক্ষমা, মার্জনা তার বেলায় সুফলপ্রসূ নয়। যুদ্ধ ও জিহাদের মাধ্যমে তার বাহ্যিক মুকাবিলাও সম্ভবপর নয়। এই উভয় প্রকার নরম ও গরম কৌশল কেবল মানুষ শত্রুর মুকাবিলায় প্রযোজ্য---শয়তানের মুকাবিলায় নয়। তাই এর প্রতিকার কেবল আল্লাহর আশ্রয়ে আসা এবং তাঁর যিকিরে মশগুল হয়ে যাওয়া। সমগ্র কোরআনে তাই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং এই বিষয়বস্তুর উপরই কোরআন খতম করা হয়েছে।
পরিণতির বিচারে উভর শত্রুর মুকাবিলার বিস্তর ব্যবধান রয়েছে : উপরে কোরআনী শিক্ষায় প্রথমে অনুগ্রহ ও সবর দ্বারা মানুষ শত্রুর প্রতিরক্ষা বর্ণিত হয়েছে। এতে সফল না হলে জিহাদ ও যুদ্ধ দ্বারা প্রতিরক্ষা করতে বলা হয়েছে। উভয় অবস্থায় মুকাবিলাকারী মু’মিন কামিয়াবী থেকে বঞ্চিত নয়। সম্পূর্ণ অকৃতকার্যতা মু’মিনের জন্য সম্ভবপর নয়। শত্রুর মুকাবিলায় বিজয়ী হলে তো তার কামিয়াবী সুস্পষ্টই, পক্ষান্তরে যদি সে পরাজিত হয় অথবা নিহত হয়, তবে পরকালের সওয়াব ও শাহাদতের ফযীলত দুনিয়ার কামিয়াবী অপেক্ষাও বেশি পাবে। সারকথা, মানুষ শত্রুর মুকাবিলায় হেরে যাওয়াও মু’মিনের জন্য ক্ষতির কথা নয়। কিন্তু শয়তানের খোশামোদ ও তাকে সন্তুষ্ট করা এবং গোনাহ্ তার মুকাবিলায় হেরে যাওয়া পরকালকে বরবাদ করারই নামান্তর। এ কারণেই শয়তান শত্রুর প্রতিরক্ষার জন্য আল্লাহ্ তা’আলার আশ্রয় নেওয়াই একমাত্র প্রতিকার। তাঁর শরণের সামনে শয়তানের প্রত্যেকটি কলাকৌশল মাকড়সার জালের ন্যায় দুর্বল।
শয়তানী চক্রান্ত ক্ষণভঙ্গুর: উপরোক্ত বর্ণনা থেকে এরূপ ধারণা করা উচিত নয় যে, তাহলে শয়তানের শক্তিই বৃহৎ। তার মুকাবিলা সুকঠিন। এহেন ধারণা দূর করার জন্য আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا নিশ্চয় শয়তানের চক্রান্ত দুর্বল। সূরা নহলে কোরআন পাঠ করার সময় আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করার আদেশ রয়েছে। সেখানে একথাও বলে দেওয়া হয়েছে যে, ঈমানদার আল্লাহর উপর ভরসাকারী অর্থাৎ আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনাকারীর উপর শয়তানের কোন জোর চলে না। বলা হয়েছে:
فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْآنَ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ--إِنَّهُ لَيْسَ لَهُ سُلْطَانٌ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ--إِنَّمَا سُلْطَانُهُ عَلَى الَّذِينَ يَتَوَلَّوْنَهُ وَالَّذِينَ هُمْ بِهِ مُشْرِكُونَ
অর্থাৎ তুমি যখন কোরআন পাঠ করো তখন বিতারিত শয়তান থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করো। যারা মুমিন ও আল্লাহর উপর ভরসা করে তাদের ওপর শয়তানের জোর চলে না। তারপর তো কেবল তাদের উপরই চলে যারা তাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে ও তাকে অংশীদার মনে করে।
কোরআনের সূচনা ও সমাপ্তি এর মিল: আল্লাহ তায়ালা সুরা ফাতেহার মাধ্যমে কুরআন পাঠ শুরু করেছেন যার সারমর্ম আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করার পর তার সাহায্য ও সরল পথে চলার তৌফিক প্রার্থনা করা। আল্লাহ তাআলার সাহায্য ও সরল পথের মধ্যেই মানুষের যাবতীয় ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কামিয়াবি নিহিত আছে। কিন্তু এ দু’টি বিষয় বর্জনে এবং অর্জনের পর তা ব্যবহারে প্রতি পদক্ষেপে অভিশপ্ত শয়তানের চক্রান্ত ও কুমন্ত্রণার জাল বিছানো থাকে। তাই এ জাল ছিন্ন করার কার্যকর পন্থা আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ দ্বারা কোরআন পাঠ সমাপ্ত করা হয়েছে।
Shahid Ibna Sahjahanさんをフォローして最新の投稿をチェックしよう!
0 件のコメント
この投稿にコメントしよう!
この投稿にはまだコメントがありません。
ぜひあなたの声を聞かせてください。